প্রথমে আমরা শবে বরাতের অর্থ জেনে নেই। প্রত্যকটি বস্তুর দুটি অর্থ থাকে একটি আভিধানিক অপরটি পারিভাষিক। শবে বরাত” এটা ফার্সী ভাষা। ” শব” অর্থ রাত, রাত্র, রজনী।” বরাত”অর্থ ভাগ্য। শবে বরাত অর্থ ভাগ্য রজনী। বরাত যদি আরবি শব্দ হিসাবে অর্থ করি তখন অর্থ হয় মুক্তি। তাহলে শবে বরাতের অর্থ হয় মুক্তির রাত।আর যদি আমরা একে সূরা দোখানের ” লায়লাতুম মুবারাকাহ” হিসাবে অর্থ করি তখন অর্থ হবে “বরকতের রাত”। আর যদি হাদীসে বর্নিত শব্দ ” লায়লাতুন্নিছফি মিন শাবান” অনুযায়ী অর্থ করি তাহলে অর্থ হবে শাবানের অর্ধ রজনী। অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ দিন গত রাত। আর পরিভাষায় এটিকেই বুঝানো হয় ” শবেবরাত”। কোরআন ও হাদীসে এরাতের ফজিলত বর্নিত রয়েছে। শবে বরাতকে নিয়ে মানুষেরা তিনভাগে বিভক্ত। ১. ছাড়াছাড়ি, কোরআন হাদিসে শবে বরাত বলে কিছু নেই, তাই এটাকে বিদআত বলে। ২.শবে বরাতকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে যেমন মাসজিদে জারবাতি অতিরিক্ত আলোকসজ্জা, গেইট তৈরি, হালুয়া রুটি, গাড়িভাড়া করে বিভিন্ন মাজারে ঘুরাঘুরি, দলে দলে কবর জিয়ারত ইত্যাদি। ৩. মধ্যম পন্থা যারা শবে বরাতকে অস্বীকার করে না এবং বাড়াবাড়িও করে না। কোরআন হাদিসে যতটুকু আছে তা মানে অতিরঞ্জন করেনা। তাঁরাই সঠিক দল।
কোরআন হাদিস হচ্ছে আরবি ভাষায় ” শবে বরাত ” হচ্ছে ফার্সি ভাষায়।তাই শবে বরাত হুবাহুব শব্দে কোরআন হাদিসে পাবেন না। যেমন নামাজ রোজা। তবে কোরআন হাদিসে পাবেন নমাজের আরবি শব্দ ” সলাত” রোজার আরবি শব্দ ” সিয়াম”। তেমনিভাবে শবে বরাত কোরআনের ভাষায় ” লায়লাতুম্মুবারাকা” বরকতময় রজনী। হাদীসের ভাষায় ” লায়লাতুন্নিসফি মিন শা বান”।
অতএব যারা বলে কোরআন হাদিসে শবে বরাত বলে কিছু নেই তাদের কথা সঠিক নয়।
মহান আল্লাহ বলেন : ” কিতাবে মুবিনের শপথ! নিশ্চয়ই আমি কোরআনকে এক বরকতময় রাতে নাযিল করেছি। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক জ্ঞানপূর্ণ বিষয় স্থিকৃত করা হয়। আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে আমিই প্রেরণকারী। সূরা দোখান আয়াত ১-৪। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত তাবেয়ী ইকরিমা (রা.) ও মুফাসসিরীনগনের একটি জামাত বলেন এর দারা “শবে বরাত” উদ্দেশ্য। অপর একটি জামাত বলেন ” শবে কদর” উদ্দেশ্য।
শবে বরাতের ফযীলত
হুযুর সা হযরত আয়েশা রা. কে সম্বোধন করে বলেন, তুমি জান এরাত্রিতে ( শবে বরাতের) কি রয়েছে? হযরত আয়েশা রা. বলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ সাঃ দয়া করে বলুন এরাতে কি রয়েছে? তিনি সা. বলেন আগামী বছর যত আদম সন্তান জন্ম নেবে এবং যারা মৃত্যুবরণ করবে তাদের নাম এ রাতে লিপিবদ্ধ করা হবে। এ রাত্রিতে বিশেষভাবে বান্দার আমলনামা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হবে।এবং তাদের রিযিক্ব অবতীর্ণ করা হবে। হযরত আয়েশা রা. তখন বলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ সাঃ! যখন বৎরের শুরুতেই আগামী বৎসরের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়, তবে মনে হয় আল্লাহর বিশেষ দয়া ছাড়া কেহই বেহেশতে যেতে পারবে না। হুযুর সা. তখন একই বাক্য তিন বার উচ্চারণ করে জবাব দেন হ্যা, আল্লাহর বিশেষ দয়া ছাড়া কেহই বেহেশতে যেতে পারবে না। আমি বললাম আপনি কি যেতে পারবেন না? তখন হুযুর সা. নিজের পবিত্র মাথায় পবিত্র হস্ত ধারণ করে জবাব দেন এবং তিন বার বলেন হ্যা আল্লাহর খাস রহমত যদি আমাকে বেষ্টন করে না লয় তবে আমিও বেহেশতে যেতে পারবো না। (মিশকাত শরীফ পৃ: ১১৫)
হযরত আতা ইবনে ইয়াসার রা. থেকে বর্নিত, বরাতের রাতে মালাকুল মউতের হাতে একটি লিষ্ট দিয়ে হুকুম করা হয়, এই লিষ্টের মধ্যে যাদের নাম রয়েছে তাদের রুহ কবজ করতে থাক। এদিকে মানুষ বৃক্ষ রোপন, বিবাহ শাদী ও ঘরবাড়ী তৈরীর কাজে লিপ্ত থাকে। অথচ তাদের নামও মৃত্যুর লিষ্টে লিখিত রয়েছে। মৃত্যুর লিষ্ট রয়েছে মালাকুল মউতের হাতে আর সেই ব্যক্তি তার মনের সাধ মিটানোর পিছে দৌরতে গিয়ে কখন যে তার জীবনের সমাপ্তি ঘটবে(জানেনা) অতএব হে লম্বা লম্বা আশা পোষণকারী, হে পাপাচারে সন্তুষ্ট ব্যক্তিরা, মৃত্যুকে ভয় কর। কেননা তুমিত জাননা তোমার মৃত্যু কখন হবে। উত্তম ঐ ব্যক্তি যে একদিন হায়াত বাকী আছে বলে কম বিশ্বাস করে এবং আগামী দিন পর্যন্ত পৌছতে পারবে বলেও আশা না রাখে। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে মৃত্যুর প্রস্তুতি মৃত্যু আসার আগেই গ্রহন করার জন্য সহজ করে দিন। ( মাজালেসুল আবরার পৃ: ১৭৭কাদীম। আল জাওয়াহের ২৫০)
হযরত আলী রা. হতে বর্নিত, হুযুর সা. এরশাদ করেন যখন শাবন (মাসের) পনের তারিখ ( শবে বরাত) উপস্থিত হয় তখন এ রাতে ইবাদত করো, এবং পরের দিন রোজা রাখ, কেননা একরাত্রিতে সন্ধ্যার পর থেকেই আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়ে ঘোষণা করতে থাকেন আছে কি কোন ক্ষমা প্রর্থনাকারী যে আমি ক্ষমা করে দেই। আছে কি কোন রিযিক্ব প্রার্থনাকারী যে আমি রিযিক্ব দান করব আছে কি কোন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি যে আমি বিপদ থেকে মুক্তি দান করব। আছে কি অমুক ব্যক্তি, আছে কি অমুক ব্যক্তি। এমনিভাবে ফরজ পর্যন্ত ঘোষণা করেন। মিশকাত শরীফ পৃ: ১১৫। শুআবুল ইমান ৩/৩৮৭। ইবনে মাজাহ ১/৪৪৪ ও ১৩৮৮।
এ হাদিসে ১৪ শাবান রাতে ইবাদত ( নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ নামাজ, কাজা নামাজ, সালাতুত তাসবী, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির আজকার ইত্যাদি ইবাদত প্রমাণিত)
পরের দিনে রোজা ( ১৫ শাবান)
( যদিও হাদিসটি সনদের দিক দিয়ে দূর্বল যেহেতু ইবাদতের প্রতি উৎসাহ প্রদানকারী তাই তার উপর আমল করা যাবে বলে সকল মুহাদ্দিসিনে কেরাম একমত পোষণ করেছেন। তাছাড়া শবে বরাতের পক্ষে অনেক সহিহ হাদিস রয়েছে, যা অচিরেই উল্লেখ করবো)
এ রাতে আল্লাহ জাল্লাশানূহু অগনিত মানুষকে ক্ষমা করে দেন। হুযুর সা. এরশাদ করেন, আল্লাহ তাআ’লা শাবানের ১৫ তারিখের রাতে নিচের আকাশে অবতীর্ণ হয়ে কবিলায়ে কালবের সমস্ত বকরির পশমের চেয়েও বেশি পরিমাণ গুনাহ মাফ করে থাকেন। তিরমিজি, ইবনি আবি শায়বা, ইবনু মাজাহ, বায়হাক্বী, মা সাবাতা বিস সুন্নাহ। ( হাদিসটি হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত এবং মাসাহীহ গ্রন্থের বিশুদ্ধ হাদিস সমূহের অন্তর্ভুক্ত। বনী কালব গোত্রের কথা একজন্য বলেছেন যে, এ গোত্রের বকরির সংখ্যা ও জনসংখ্যা অন্যান্ন গোত্রের চেয়ে বেশি)
শাবান মাসের অর্ধ রজনী সম্পর্কে সহিহ হাদিস সমূহ
হযরত আবু মুসা আশ আরী রা. হতে বর্নিত হুযুর সা. এরশাদ ফরমান, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা শাবানের পনের তারিখের রাতে( ১৪ তারিখ দিন গত রাতে) তার বান্দার প্রতি দয়ার দৃষ্টিপাত করেন। অতপর মুশরিক ও শত্রুতা পোষণকারীদেরকে ছাড়া তার অন্যান্য সকল বান্দাদেরকেই অন্য বর্ননায় সকল সৃষ্টিকে ক্ষনা করে দেন। (মিশকাত পৃ১১৫) কিতাবুস সুন্নাহ ১/২২৩। ( উক্ত হাদিসটি ১০ জন সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত )
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্নিত নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, শাবানের অর্ধ রজনীতে আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টির প্রতি করুনার দৃষ্টি দেন অতঃপর তার বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। তবে দু শ্রেণির মানুষকে ক্ষমা করেন না হিংসুক এবং হত্যাকারী। মুসনাদে আহমদ ২/ ১৭৬।
হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. হুজুর সা. থেকে বর্ননা করেন, তিনি বলেন শাবানের অর্ধ রজনীতে আল্লাহ তায়ালা করুনার দৃষ্টি দেন অতঃপর তার সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন তবে মুশরিক এবং হিংসুক ছাড়া। কিতাবুস সুন্নাহ ১/ ২২৪। আত তারগীব ২/ ২৪১। সহিহ ইবনে হিব্বান ৫৬৬৫। আল মাজমাউল কবীর ২০/ ১০৯। শুআাবুল ইমান ৬৬২৮। মুসনাদে বাজ্জার ২৪৫। আজ্জাওয়ায়েদ ৮/৬৫।
আল্লাহর রসূল সা. বলেছেন যখন শাবানের অর্ধ রজনী আসে আল্লাহ তার বান্দার প্রতি দয়ার দৃষ্টি দেন অতঃপর তিনি মুমিনদেরকে ক্ষমা করেন তবে হিংসা বিদ্বেষ পোষণকারীকে ক্ষমা করেন না। কিতাবুস সুন্নাহ ১/২২৩।
(উল্লেখিত হাদিসটি হযরত আবু সালাবা থেকে বর্ণিত)
এ বরকতময় রাতে আল্লাহ যাদের প্রতি দয়ার দৃষ্টি দেবেন না এবং ক্ষমাও করবেন না।
১. মুশরীক, ২. হিংসুক, ৩. শত্রুতা পোষন কারী ( অন্যায়ভাবে কোন মুসলমান ভাইয়ের প্রতি), ৪. টাখনুর নিচে লুঙ্গি / পায়জামা পরিধানকারী, ৫. মাতা- পিতার অবাধ্য সন্তান, ৬. মদ্যপানে অভ্যস্ত, ৭. অন্যায়ভাবে হত্যাকারী, ৮. অন্যায়ভাবে ট্যাক্স গ্রহনকারী, ৯. যাদুকর, ১০. গণক,১১. জুয়ারী, ১২. ব্যবাবিরচারকারী, ১৩. গান বাজনা কারী, অত্যাচারী সৈনিক।
শবে বরাতের রাত ইবাদতের পদ্ধতি
১. নফল নামাজ পড়া ( আমি দু রাকাত নফল (সুন্নত)নামাজ পড়ছি আল্লাহু আকবার) অথবা তাহাজ্জুদের নিয়ত করতে পারেন ২ রাকাত করে।
দু দু রাকাত করে যে যত রাকাত পড়তে পারে কোন ধরা বান্দা নেই যে এত (১২/ ২০/ ১০০) রাকাতি পড়তে হবে। রাকাতের সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে নামাজে সৌন্দর্যের ( রুকু সেজদাহ)দেরী করে পড়ার ভালো। সূরা ফাতিহার সাথে যে কোন সূরা মিলাতে পারবে, অমুক সূরাই পড়তে হবে এতবার পড়তে হবে এমন কিছু নয়। তাহাজ্জুদ, তাছাড়া সালাতুত তাসবিহ, উমরি ক্নাজা নামাজও পড়তে পারবে। কোরআন তেলাওয়াত জিকির তাসবিহ, তাহলিল, তাওবা ইস্তেগফার ইত্যাদি ইবাদত করতে পারবে। এই নামাজের জন্য মাইকে ডাকা ডাকি করবে না। এবং ঘরে ইবাদত করা উত্তম। অনেকে বলে ঘরে নামাজের পরিবেশ নেই তাই মসজিদে আসি। ঘরে নামাজের পরিবেশ করবেন। মসজিদে গিয়েও পড়তে পারবেন। ফরজ নামাজের চেয়ে নফল নামাজের বেশি গুরুত্ব দিয়ে দলে দলে লোক মসজিদে যাওয়া ওলামায়ে কেরাম নাজায়েজ বলেছেন।
২. একা একা গিয়ে কবর জিয়ারত করতে পারবে। দলে দলে সবাইকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে না যাওয়া। আড়ম্বর করে যাওয়া যাবে না। মসজিদে আলোকসজ্জা, কবরস্থান আলোকসজ্জা, বাজি ফোটানে ইত্যাদি অন্যায়।
৩. ১৫ শাবান ( রাতে ইবাদত পরের দিন) রোজা রাখবেন। শাবান মাসের রোজা এটিই। কেউ চাই ১৩, ১৪, ১৫ শাবান রোজা রাখতে পারবে একে বলে আইয়্যামে বিজের রোজা যা রাসূল সা. প্রতি চন্দ্র মাসে রাখতেন। প্রতি সোমবার বৃহস্পতিবার রোজা রাখতে পারেন।
সারা রাত শবে বরাতের ইবাদত করলেন কিন্তু যদি ফজরের নামাজ না পড়েন। তার নাজাতের আশা থাকেনা। কিন্তু কেউ শবে বরাতে ইবাদত করেনি কিন্তু ফরজ ওয়াজিব ছাড়েনি তার নাজাতের আশা করা যায়।
শবে বরাতের রাত ইবাদতের নামে আমরা বাড়াবাড়ি করে সোয়াবের বিপরিদে গোনাহ যেন না কামাই। আল্লাহ আমাদের সহিহ বুঝ দান করুন।
১৪ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার( ২০২৫ইং) দিন গত রাত শবে বরাতের ইবাদত পরের দিন শনিবার রোজা।
লেখক : মোহতামীম, আইনূল উলূম মাদরাসা ও এতিমখানা, দূ্র্গাপুর নেত্রকোনা